ভারতের বাংলা অভিনয় জগতের কিংবদন্তী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি একাধারে সফল মঞ্চাভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, কবি এবং এক্ষণ নামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন । মি. চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ১৯শে জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে।
তাদের পরিবারের আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় শিলাইদহের কাছে কয়া নামে একটি গ্রামে। তার পিতামহের সময় থেকে তারা কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন।
কৃষ্ণনগরেই ছিল তার স্কুলের প্রাথমিক লেখাপড়া। পরে কাজের সুবাদে তার বাবা কলকাতায় চলে এলে পরবর্তীতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নেন কলকাতাতেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমহার্স্ট স্ট্রীট সিটি কলেজে, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অপুর সংসার ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বপ্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়-এর অপুর সংসার ছবিতে, শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে, যা ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ছবিটি পরিচালকের ৫ম চলচিত্র পরিচালনা। তিনি এর আগে রেডিয়োর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লেখা হয়। সত্যজিৎ রায়-এর দ্বিতীয় শেষ চলচিত্র শাখা প্রশাখা-তেও তিনি অভিনয় করেন। তার চেহারা দেখে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ”। অনেকের মতে, সত্যজিতের মানসপুত্র সৌমিত্র।
ফেলুদা
তার অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতেননা।
এছাড়াও সৌমিত্রর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘অশনিসংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘দেবদাস’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গণদেবতা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘আতঙ্ক’, ‘গণশত্রু’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘তিন কন্যা’, ‘আগুন’, ‘শাস্তি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’প্রভৃতি।
অভিনয়ে তার অবদানের জন্য দেশি বিদেশি অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২০০৪ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন দুবার, এবং সিনেমায় তার সারাজীবনের অবদানের জন্য ২০১২ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের সবোর্চ্চ চলচ্চিত্র খেতাব ‘দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননা’।
নাট্যশিল্পে তার অবদানের জন্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফরাসি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৯৯ সালে পান সম্মানজনক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি Commandeur de l’ Ordre des Arts et des Lettres।তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেতা যাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২০১৭ সালে তিনি ফরাসি সরকারের বেসামরিক সম্মাননা লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত হন।
২০২০ সালের ১ অক্টোবর বাড়িতে থাকা অবস্থাতে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শমতে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। এর পরের দিন ৬ অক্টোবর তাকে বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি হন। এখানে ১৪ অক্টোবর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর সৌমিত্র খানিক সুস্থ হতে থাকেন। চিকিৎসা চলা অবস্থাতে ২৪ অক্টোবর রাতে অবস্থার অবনতি ঘটে। কিডনির ডায়ালাইসিস করানো হয়, প্লাজমা থেরাপি পূর্বেই দেয়া হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে পরিবারের লোকজনকে জানানো হয়। অবশেষে ১৫ই নভেম্বর, ২০২০ তারিখে ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।