শেষ পর্ব
আমি যত্ন করি তাই আমি আছি
বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে এই কথাটা শুনতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পুরানা সব নিষ্ঠুরতা ও মানবিকতার গল্প পাশা-পাশি চলছে। এলান বাদিও এটা ঠিক ধরতে পারেনি বলে মনে করি। তিনি, তার লেখাতে বলেছেন সত্যকে এখন বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করে। আসলে সত্যকে কোন ভাবেই বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করে না। সত্যকে দর্শনও নিয়ন্ত্রণ করে না। মূলত সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে সত্য। বিজ্ঞান সর্বাধিক যেটা পারে সত্যকে মিমিক বা নকল করতে পারে। নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাদিউর এই কমেন্ট বিষ্মকর ভাবে হতাশাজনক।
মাওবাদি উচ্ছ্বাস থেকে তারা যাই বলুন না কেন, এখনও চলছে জীবন। চলছে মৃত্যু। এই করোনা দুনিয়ার ক্ষমতা ও রাজনীতি বা অর্থব্যবস্থার কোন বিপ্লবী পরির্বতন নিয়ে আসবে না— এটা পরিস্কার। আর সংকট পুঁজিবাদের নিজের বিকাশের নিয়মেরই অংশ— এটা কে না জানেন? ফলে তাদের চিন্তার বিকাশের পশ্চিমা পদ্ধতির যে ধারাবাহিকতা ধরে আজ তারা একই সাথে এই সভ্যতার বিকাশের সূত্র মেনে নিয়ে বিপ্লবের কথা বলেন, তা পদ্ধতিগত ভাবে সঠিক না।
একই সাথে প্রযুক্তিগত দুনিয়া ও সাম্যবাদি বিপ্লবী জীবনের চিন্তার কারণে তৈরি হয় চিনের মতো যান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র। যদিও বাদিউ ও জিজেক উভয়েই এই বিষয়ে খুব আশাবাদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলেন মাঝে মাঝে। চানার ব্যাপারেও তারা অতি আশাবাদি হয়ে ওঠেন। কিন্তু করোনা প্রশ্নে তারা চলতি ফেনোমেনার হুজুগের শিকারে পরিণত হয়েছে। আমাদের চিন্তকরা এই ফোনোমেনাকে শিকার করতে পারেন নাই— আপসোস।
আমাদের আজকে সব চেয়ে বেশি মনে পড়ে, হাইডেগারের কথা। আমাদের আরও মনে পড়ে জ্যাক দেরিদার কথা। রাষ্ট্র, বিজ্ঞান সব ব্যর্থ হওয়ার পরেও আমরা আশাবাদি হই, বা আশাবাদি হতে বাধ্য হই। ‘গিফ্ট অব ডেথ’ বইয়ে জ্যাক দেরিদা যেমন বলেন,
Even if we’re in a state of hopelessness, a sense of expectation is an integral part of our relationship to time.
আমরা যদি চরম আশাহীন একটি রাষ্ট্র বা ব্যাবস্থার মধ্যেও বাস করি তার পরও সময়ের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক তার সাথেই আমাদের আশাবাদি হয়ে উঠার একটা গোপন/গভীর সংযোগ আছে। কিন্তু আসলে আমরা সময়ের দাবি বা ডাক বুঝে নিয়ে চিন্তা করতে ভুলে গেছি এখন।
মাওবাদি উচ্ছ্বাস থেকে তারা যাই বলুন না কেন, এখনও চলছে জীবন। চলছে মৃত্যু। এই করোনা দুনিয়ার ক্ষমতা ও রাজনীতি বা অর্থব্যবস্থার কোন বিপ্লবী পরির্বতন নিয়ে আসবে না— এটা পরিস্কার। আর সংকট পুঁজিবাদের নিজের বিকাশের নিয়মেরই অংশ— এটা কে না জানেন? ফলে তাদের চিন্তার বিকাশের পশ্চিমা পদ্ধতির যে ধারাবাহিকতা ধরে আজ তারা একই সাথে এই সভ্যতার বিকাশের সূত্র মেনে নিয়ে বিপ্লবের কথা বলেন, তা পদ্ধতিগত ভাবে সঠিক না
অন্যভাবেও ভাবা যায়, পশুর সাথে জীবনের যে সম্পর্ক আর মানুষের সাথে ’জীবনের’ যে সম্পর্ক তা শুধু প্রযুক্তিগত বিকাশের আলোকে মিটিয়ে ফেলার যে গল্প সভ্যতার নামে আমরা চালু করেছিলাম তা মিথ্যা হয়ে গেছে এই করোনার কালে।
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছাড়া মৃত্যুকে আর কোন ভাবে জয় করা যায় না— এটাকি আমরা এতোদিনেও বুঝতে পেরেছি? ডেথ কোন পশুর জীবনের জন্য কখনও ইভেন্ট/উপলক্ষ হতে পারে না। কিন্তু মানুষের জীবনের জন্য ডেথও ইভেন্ট। যদিও এথিস্ট একজিসটেশিয়ালিস্টরা মানে অবিশ্বাসী সত্ত্বাতাত্বিকরা এটা মানে না। তাদের মতে মৃত্যু কোন ইভেন্ট হতে পারে না।
করোনার কালে তারকা দার্শনিকরা মানুষকে হতাশ করেছেন, তার একটি বড় কারণ হল, তিনারা প্রশ্ন তোলার জরুরী কাজটাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে সামাধান বা উত্তর দেয়ার কাজ বা করোনার কালে ডাক্তারদের ভূমিকায় হাজির হতে চেয়েছেন মনে হচ্ছে।
করোনার কালে আমাদের অতি বিজ্ঞানবাদি প্রবণতা থেকে জ্ঞানতাত্বিক/এপিসটিক অবস্থান থেকে সব কিছুকে দেখার ফলে— এই দিশাহীন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
আমাদের অন্টিক/সত্ত্বার প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার ছিল। অন্টলজিক্যাল ও একজিসটেশিয়াল (সত্ত্বা ও তার হাজির বা থাকা) এর জায়গা থেকে আমরা করোনা ফেনোমেনাকে যদি ব্যাখ্যা করতে শুরু করি তাহলে দেখা যাবে দর্শন খুব পরিস্কার ভাবে (এই একবিংশ শতকে, এই বিজ্ঞানের হাইপার রিয়ালিটির কালেও) মানুষের আতঙ্কের সব রহস্য ব্যাখ্যা করতে পারছে।
অন্যদিকে খোদ সেই পুরানা প্রশ্নটি আবারও এমনকি বারবারই উঠাতে হবে— জীবন কি?
মৃত্যুর মিছিলের কালেও এই প্রশ্নের গুরুত্ব তো এতটুকু কমে না… তাই চিন্তা বা দর্শনের কাজও এতোকুটু কমে না। তবে চিন্তা করা যে, সবচেয়ে জরুরী ও কঠিন কাজ— আমরা কি এটা ভুলে গেছি?
মাহামারির কালে দর্শন আসলে কি দিতে পারে আমাদের? দর্শন আমাদের কীভাবে পাশে দাঁড়াতে পারে?
যে জীবের জীবন, যে বায়োলজিক্যাল জীবন হারানোর ভয়ে মানুষ অতঙ্কিত, বিশ্বজুড়ে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা দেখা দিচ্ছে, দর্শন কি কাজে লাগতে পারে এখন?
আমরা কেন ‘জীবন’ রেখে মৃত্যু ও রাষ্ট্র নিয়ে উতলা হলাম? আসলে আমাদের চিন্তাশীলতার মধ্যে সেই মেডিটেশন/সাধনা বা পয়েসির অভাব দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, বিজ্ঞান বনাম জীবন। ভাইরাস বনাম মানুষ এই যে বাইনারী, একের বিপরীতে অন্যের জীবনকে দেখবার যে তরিকা এটা কেন আমাদের গ্রাস করে নিলো? আমরা কেন প্রত্যেককে যার যার মিনিং বা অর্থ ও অবস্থানবা প্রকৃতি ধরে চিনতে মেহতন করি না। কেন সব কিছুকে তুলনার মাধ্যমে দেখি? মানুষ বনাম ভাইরাস…
—এর বাইরে কি আমরা করোনাকে দেখতে পারেছি?
এই যে জীবন, এর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক আর অদৃশ্য এক ভাইরাসের সাথে শত্রুতা— এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে আমরা কতটা আগাইলাম?
মানুষকে একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে! আর হাস্যকর ভাবে, পথে নামছে পুলিশ, সেনা ও ডাক্তার।
আর তাতে মেসিয়া/ত্রাণকর্তা হিসেবে এখনও তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বিজ্ঞানের দিকে।
করোনার প্রতি আমাদের প্রথম দার্শনিকগলদটা হয়েছে আমরা এপিসটিক জ্ঞানতাত্বিক ভাবে এটা মোকাবেলা করতে চেয়েছি। আমরা অনটিং বা বিং এর প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গিয়েছি। আমরা ধরেই নিয়েছি পৃথিবীর এই যে বিজ্ঞানময় বাস্তবতা তাতে অদৃশ্য (খালি চোখে দেখা যায় না) কোন কিছু আমাদের কাছে সাবজেক্ট এর মর্যাদা পেতে পারে না। আমরা ‘ট্রুথ এন্ড মেথড/ ডিসকোর্স’ বা সত্যের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক ভুলে গিয়ে একটা ফেনোমেনা/ঘটনা থেকে যারা যার মতো ফায়দা নেয়ার কাজে ব্যাবহার করতে শুরু করেছি। করোনা ভাইরাস আমাদের টেকনোলজিক্যাল সুপার ইগোর বা অহং এর প্রতি একটা বড় আঘাত। আমাদের যে জীবের জীবন এর সাথে মৃত্যুর যে নিত্য সম্পর্ক তাকে নিশ্চিত জ্ঞান করার সত্য থেকে যে টেকনোলজিক্যাল ইলোশন আমাদের দূরে রাখে— এটাই তো করোনার কালে প্যানিক তৈরির মূল কারণ।
করোনার কালে আমাদের সব চেয়ে বড় শক্তি নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। আর এটার জন্য সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন যত্ম/কেয়ার। হাইডেগার কেয়ার কথাটা কত বার, কত ভাবে বুঝিয়েছেন। আমরা বুঝি নাই। এই যত্মই আমাদের যেমন রক্ষা করতে পারে। যত্মই করোনাকে আমাদের জন্য সহনীয় করে দিতে পারে। আমাদের জীবনী শক্তিকে করতে পারে প্রকৃতির মতো বিস্ময়কর। অন্যকেও নিরাপদ করতে পারে। এমন একটা দুনিয়া কি হতে পারে না আমরা করোনার জন্য সহনীয় আর করোনাও আমাদের জন্য সহনীয়?
যত্ম মানে শুধু নিজের যত্ম না। দুনিয়ার যত্ম। নিজের জীবনের যত্ম মানে নিজের মৃত্যুরও যত্ম। মৃত্যু এমন এক বন্ধু যে খুব নিকটে থাকে। এবং জীবনে একবারই দেখা হয়। সেটাই প্রথম এবং শেষ দেখা।
আধুনিকতার সব শিক্ষার বিরুদ্ধে করোনা একটি বড় শিক্ষা হতে পারে। আমাকে দুনিয়ার দৃশ্য-অদৃশ্য সব কিছুর সাথে মানে, জীবন ও মৃত্যু উভয়ের সাথে একিভূত হয়ে বাস করতে হবে।
আর রাজনৈতিক ভাবেও আমরা সুবিধা করতে পারছি না কারণ আমরা অন্টিক/আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আশীষ নন্দী যেমন বলেন, “দ্রুত পরির্বতনশীল সমাজে, আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন কৌশলী আক্রমনের সামনে আত্মসত্তা হারাবার সমস্যাটির জন্য স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কম কার্যকরী।”
থাকা কথাটির সাথে কেয়ার বা যত্ন কথাটির গভীর সম্পর্ক। আমাদের বলতে হবে, আমরা থাকি যত্নে। দুনিয়ার এই যে বিশাল বিস্তার তার মধ্যে প্রকৃতি মূলত জীবনের প্রতি নিজেকে খুব যত্মশীল রেখেছে। কিন্তু মানুষ প্রকৃতি তো দূরের কথা নিজের প্রতি এবং অন্য মানুষের প্রতি নিজেকে যত্মশীল রাখতে পারে নাই। এক আত্মধ্বংসের লীলা চলছে চারপাশে। করোনা কালে দেকার্ত এর আদলে বলা যায় , আই কেয়ার দেয়ার ফর আই এম। আমি যত্ন করি তাই আমি আছি বা থাকি
আমরা কি মানুষকে বলতে পেরেছি, অন্যের অধিকার নষ্ট করে যে ‘জীবন’ বাঁচাতে তুমি এতো কিছু করছো তুমি কি জানো এই ‘জীবন’ মানে কি?
জীবনের ব্যাবহার কি? ‘গিফ্ট অব ডেথ’ কি? মৃত্যুর উপহারটা কেমন? মৃত্যু জীবনকে কি উপহার দেয়?
জীবন, সময় ও মৃত্যুর সাথে অন্টিক ও বিং বা হয়ে ওঠার সম্পর্ক নিয়ে আমরা আজও যথেষ্ট চিন্তা করি নাই। আমরা কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নামে দিন দিন জীবনকে আরও ব্যবহারাদি করে তুলে নাই? আমরা কি এই প্রযুক্তি-অন্ধ হুজুগের ভোগের আমোদে জীবনকে যথাযথ ভাবে যত্ম করি? জীবন কথাটা বারবার আমরা উচ্চারণ করি। এখানেও বারবার বলছি। কিন্তু আমরা কি জীবনকে জীবনের মতো করে জানি। অথবা জানতে চেষ্টা করি। আমরা কি কেয়ার বা যত্ম করি?
হাইডেগার যেভাবে বলেছিল, ‘অনলি ডেথ ইজ পারসোনাল’। এবং এখন আরও গভীর ভাবে একজিসটেশিয়াল/হাজির থাকার প্রশ্ন নিয়ে আমাদের চিন্তার দরকার ছিল। বিং বা হওয়া বা থাকার তাৎপর্য কি? এটা আমরা আজও বুঝি নাই। এই থাকা কথাটির সাথে কেয়ার বা যত্ন কথাটির গভীর সম্পর্ক। আমাদের বলতে হবে, আমরা থাকি যত্নে। দুনিয়ার এই যে বিশাল বিস্তার তার মধ্যে প্রকৃতি মূলত জীবনের প্রতি নিজেকে খুব যত্মশীল রেখেছে। কিন্তু মানুষ প্রকৃতি তো দূরের কথা নিজের প্রতি এবং অন্য মানুষের প্রতি নিজেকে যত্মশীল রাখতে পারে নাই। এক আত্মধ্বংসের লীলা চলছে চারপাশে। করোনা কালে দেকার্ত এর আদলে বলা যায় , আই কেয়ার দেয়ার ফর আই এম। আমি যত্ন করি তাই আমি আছি বা থাকি। নিজের যত্ম মানে দুনিয়ার প্রতি যত্মশীল হওয়া— এই কথার অর্থটা ব্যাপক ভাবে বুঝতে হবে।
ভাবতে হবে, এমন একটা দুনিয়ার কথা। যেখানে দৃশ্য-অদৃশ্য কাউকে শত্রু আকারে ধরে নিয়ে জীবন শুরু করার দরকার থাকবে না। করোনার কালে আমাদের প্রথম দার্শনিক প্রতিক্রিয়া হবে, যে সভ্যতার ডিসকোর্সগুলো দিয়ে এই দুনিয়া পরিচালিত হয় তাতে মানুষের জীবের জীবনই নিরাপদ না। তার জ্ঞানগত পরম/ট্রান্সিডেন্টাল জীবন তো দূরের করা। ফলে এই সভ্যতাকে যে চিন্তার ধারাবাকিহতা আকারে আমরা এই জায়গায় নিয়ে এসেছি তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আবার আমাদের শুরু থেকে আরম্ভ করতে হবে। আমাদের চিন্তা করা দরকার। ভীষণ রকম দরকার। মনে রাখতে হবে, যত্ম/কেয়ার চিন্তারই একটি ব্যবহারিক রুপ।
প্রকাশিতব্য গ্রস্থ: `The war between faith and science: philosophical response on a twenty-first-century pandemic’ থেকে দরকারী কিছু অংশ নিয়ে ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য এই প্রবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে