বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানায় বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরকে ঘিরেই ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা। বিশাল উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উপার্জনের অন্যতম আশ্রয়স্থলে বড় বাধা মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার অস্ত্রধারী জলদস্যুরা। এ জলদস্যুরা শান্ত সাগরকে অশান্ত করে রাখত সব সময়।
২০১৯ সালে ২৩ নভেম্বর গণমাধ্যমকর্মী ও প্রশাসনের সহযোগিতায় সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কক্সবাজারে দুদফায় স্বেচ্ছায় শতাধিক জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে। এতে উপকুলীয় এলাকাগুলোতে শান্তির হাওয়া বইছে। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর জলদস্যুরাও সরকারি সহায়তায় ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনে। এতে সাগরের পাশাপাশি অপরাধের স্বর্গরাজ্যখ্যাত মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় সাগরের মোহনায় ৯০ শতাংশ অপরাধ কমে এসেছে।
জানা গেছে, মহেশখালী কালামারছড়া ও কুতুবদিয়ায় হাজার হাজার উপকূলবর্তী মানুষ দীর্ঘদিন জলদস্যুদের কাছে জিম্মি হয়েছিল। অনেকে জলদস্যুর দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করতেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় আত্মসমর্পণের কারণে সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। কিন্তু আত্মসমপর্ণের পর জেল থেকে মুক্তির এক বছর পার হলেও নিজের ভিটেমাটি ও এলাকায় ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন মহেশখালীর কালারমারছড়া এলাকার জলদস্যুদের অনেকেই।
অভিযোগ উঠেছে, শীর্ষ গডফাদার তারেক শরীফের মন রক্ষা না করায় আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুরা অনেকে অভিযোগ করে বলেন, নিজের ভিটেমাটি ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বাধা দিচ্ছেন খোদ মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল হাই।
জলদস্যুদের দাবি, সন্ত্রাসীদের গডফাদারখ্যাত মহেশখালীর কালারমারছড়ার চেয়ারম্যান তারেক শরীফকে রাজি করে তাদের এলাকায় ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ। জলদস্যু সাদ্দাম হোসেন বলেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারিভাবে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাসে তিনি এবং তার ভাইয়েরা সাংবাদিক আকরাম হোসাইনের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আজও তিনি নিজ ভিটেমাটিতে ফিরতে পারেননি।
তিনি বলেন, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আকরাম হোসাইনের পরামর্শে পুলিশের সহযোগিতা চাইতে তারা কয়েকজন মিলে থানায় যান। মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের বেশ আপ্যায়ন করেন।
কিন্তু এলাকায় বসবাস ও নিজ ভিটায় ঘরবাড়ি করতে গেলে স্থানীয় চেয়ারম্যান তারেক শরীফকে রাজি করার পরামর্শ দেন মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল হাই। প্রয়োজনে চেয়ারম্যান তারেকের পক্ষে নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হলেও তাকে রাজি করতে বলেন। জলদস্যু সাদ্দাম হোসাইন বলেন, এর মানে হচ্ছে আমাদের স্বভাবিক জীবনে ফিরতে না দেওয়া ও আগের পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য করা। প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে ইতোমধ্যে অনেকেই পুরোনো পেশায় ফিরে গেছেন বলে দাবি তার।
সম্প্রতি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন জলদস্যু আয়ুব আলী। গ্রেফতারের আগে আয়ুব আলী
জানান, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা কয়েকজন মিলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের সঙ্গে দেখা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহযোগিতা চান। এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কালারমারছড়ার চেয়ারম্যান তারেক শরীফ।
এমপি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা জলদস্যুদের এলাকায় বসবাস করতে দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যান তারেক শরীফকে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানালে ওই সময় তারেক তাদের ওসির সহযোগিতা নিতে বলেন। পরে তারা ৮ জন মিলে মহেশখালী ওসির সঙ্গে দেখা করলে তিনি সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
আয়ুব আলীর দাবি, যেদিন তারা ঘর তৈরির জন্য একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রস্তুতি নেন, ওইদিন কালারমারছড়ার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম গিয়ে ঘর তৈরিতে বাধা দেন এবং চেয়ারম্যান তারেকের সঙ্গে সমঝোতা করে ঘর তৈরি ও এলাকায় থাকতে হবে বলে জানিয়ে দেন।
একই ধরনের অভিযোগ করেছেন আত্মসমর্পণ করে জেল থেকে মুক্তি পাওয়া আজিজুল হক, মানিকসহ আরও কয়েকজন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কালারমারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তারেক শরীফ বলেন, এসব জলদস্যু আত্মসমর্পণকালে আমি নিজেও সহযোগিতা করেছি। কিন্তু যাদের জন্ম থেকে পেশা জলদস্যুতা। তারা কিভাবে ভালো হবে। এলাকায় ফিরতে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবার হত্যাকারীদের তো আমি পুনর্বাসন করতে পারি না। তাছাড়া তারা এলাকায় ফিরলে সাধারণ জনতার জনরোষে পড়তে পারে। কারণ তারা আমার আরও ৭-৮ জনকে হত্যা করেছে। সরকারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করলে এখন এলাকায় ঢুকতে বাধা দেওয়ার কারণ কি? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি বাধ্য নন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহেশখালী থানার ওসি আবদুল হাই বলেন, তারা নিজেদের বাড়িতে ঘর করবেন তাতে আমরা কেন বাধা দিতে যাব। বরং তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করব।
সূত্রঃ যুগান্তর