
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের জাজিনদী, কালন্দি খাল ও মরানদী দিয়ে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা থেকে বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত পানি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দূষিত পানির সঙ্গে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ এসে জমা হচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ভারী ধাতুর উপস্থিতির কারণে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, আগরতলা শহরের ভূগর্ভস্থ কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা, গৃহস্থালির বর্জ্য, নর্দমার ময়লা এবং শহরের স্যুয়ারেজ লাইনের দূষিত পানি কালন্দি খাল, মরানদী ও জাজিনদী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই পানিতে সিসা, সালফার, দস্তা, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যাডমিয়াম ও আয়রনের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
দূষিত এই পানি তিতাস নদীতে মিশে সীমান্তবর্তী দুটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রায় ২০-২৫টি গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। একইসঙ্গে, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে, ফলে স্থানীয় জেলেদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কালন্দি খাল, বাউতলার মরানদী এবং জাজিনদী খালে দূষিত বর্জ্য ভেসে আসছে। আখাউড়া পৌর এলাকা হয়ে এই পানি তিতাস নদীতে গিয়ে মিশছে, যার ফলে দুর্গন্ধে নিত্যদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, পর্যটক, বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত এই দুর্গন্ধ সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় মিঠা পানির অন্যতম উৎস ছিল এই খালগুলোর পানি। কিন্তু এখন এটি ‘কালো পানির খাল’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। পানি পরিশোধনের দাবি বহু বছর ধরে জানানো হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যৌথ নদী কমিশন পানি পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করলেও তা কেবলমাত্র নমুনা সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ এখনো নেওয়া হয়নি।
ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কয়েক বছর আগে দূষিত পানি পরিশোধনের জন্য ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনের আশ্বাস দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পানীয় জল ও স্বাস্থ্যবিধি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আরাম কৃপাল যাদব আখাউড়া স্থলবন্দরের নো-ম্যান্সল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ইটিপি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এক দশক পার হলেও এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের বিএনপি দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী আলহাজ্ব মো. কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, “দূষিত পানির কারণে আমাদের কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, হাঁস-মুরগি পর্যন্ত মরে যাচ্ছে। জেলেরা আগের মতো দেশীয় মাছ পাচ্ছেন না, কারণ ভারতের বিষাক্ত কালো পানি আমাদের নদীগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই, এই দূষিত পানি পরিশোধন করেই বাংলাদেশে প্রবেশ করুক, যেন কৃষি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা পায়।”
আখাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছাম্মদ তানিয়া তাবাসসুম জানান, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ঢাকা থেকে পরীক্ষা করে পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পানির মান ভালো না হলেও স্থানীয় কৃষকরা বাধ্য হয়ে এটি ব্যবহার করছেন। তবে কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হিমেল খান বলেন, “এই দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জির মতো রোগ হতে পারে। এমনকি এই পানির মাছও মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”