দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মৌলিক মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ অর্থ বাস্তবসম্মত ও যথেষ্ট নয় এবং যে বরাদ্দ দেয়া হয় তাও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যথাযথভাবে তাদের কাছে পৌঁছায় না।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গতকাল (বৃহস্পতিবার) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিবন্ধিতা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসব তথ্য জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির বরিশাল বিভাগীয় স্বেচ্ছাসেবক দেলোয়ার হোসেন রেডিও তেহরানকে জানান, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর যথাযথভাবে তা কার্যকর করার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। এমনিতে এ খাতে সরকারের বরাদ্দ অপর্যাপ্ত ; তারপর সরকারি সাহায্য পেতেও দুর্নীতির শিকার হতে হয় প্রতিবন্ধীদের ।
টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে, দেশে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় মাসে ৭৫০ টাকা করে ১৮ লাখ প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেয়া হচ্ছে, যা জীবনধারণের চাহিদা পূরণে এবং প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা বিবেচনায় অনেক কম। অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী-বান্ধব পরিবেশ ও বিশেষায়িত সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেই। প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে তথ্যের গড়মিল রয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন- ২০১৩, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩, এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও এগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন- প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ আইনটি কোন্ কোন্ আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এর ফলে ‘লুনেসি’ আইনে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিরা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদ পাবে না উল্লেখ থাকায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ বাস্তবায়নে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা অগ্রসরে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। জাতীয় বাজেটে সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখা হয়নি, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যয় হলেও সেটা এ খাতের প্রকৃত বরাদ্দ কি না তা স্পষ্ট নয়।
সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতি
গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা গেছে, সমাজসেবার কার্যালয়গুলোয় এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে জনবলের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। দৃষ্টি, বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে জনবল এবং সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকসহ অন্যান্য জনবলের চাকরি নিয়মিতকরণের অনুমোদনে ফাউন্ডেশন ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। ফলে প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত পাঠদান কম গুরুত্ব পাচ্ছে।
এ ছাড়া, প্রতিবন্ধী-সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে থেরাপিস্ট এবং থেরাপিস্ট সহকারীদের একাংশের থেরাপি সংক্রান্ত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ও প্রযুক্তিগত উপকরণ ব্যবহারে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ টিন-শেড ভবনে পাঠদান কার্যক্রম হয়। অনেক বিদ্যালয়ে সংলগ্ন মাঠ নেই, এবং থেরাপির জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ মেশিন অকেজো। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিদ্যালয় নেই- সরকারি দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পাঁচটি, সরকারি বাক-শ্রবণ-প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় আটটি, এমপিওভুক্ত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় জেলার সদর উপজেলাকেন্দ্রিক।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘উন্নয়নে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিতের ধারণা ও অঙ্গীকার প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমাদের প্রেক্ষাপটে যে প্রযোজ্য নয়, তার বাস্তব চিত্রটা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আইন-নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষেত্র-বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যে অন্তর্ভুক্তিমূলক, তা বলা যাবে না।’
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ১৪ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করছে টিআইবি।
১৪ দফা সুপারিশ
প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে টিআইবির ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, গণশৌচাগারসহ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী সংশ্লিষ্ট সেবায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে টিআইবি।