ছবিঃ প্রথম আলো
বাংলাদেশে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের অনাস্থাভাজন আর সরকারের অনুগত থাকাসহ নানা অভিযোগ-অনুযোগ মাথায় নিয়ে আজ সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি)বিদায় নিচ্ছে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
পাঁচ বছর দায়িত্বে থেকে বিদায়ী কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, সকল সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং অনেকগুলো উপনির্বাচনসহ মোট ৬ হাজার ৬৯০টি নির্বাচন সম্পন্ন করেছে।
কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিদায় লগ্নে অনেকটা সাফাইয়ের সুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক-সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ বলেছেন, সরকার কখনোই নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেনি
বিদায় উপলক্ষে গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে আজ সকাল ১১টায় কমিশন ভবনের লেকভিউ চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বেলা একটার দিকে ইসি ভবনে নিজ কক্ষের সামনে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
বিদায়ী বক্তব্যে সিইসি নুরুল হুদা বলেছেন, পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারপরেও সফলভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। তবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছে। শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। নির্বাচনে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
নুরুল হুদা স্বীকার করেছেন, তার কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সন্তুষ্ট নয়। আমরা তাদের আস্থা অর্জন করতে পারিনি। এ নিয়ে আমরা বিব্রত নই। আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ছিল কঠোর পরিশ্রম করে সে দায়িত্ব পালন করেছি।
‘নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে’
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অনুপস্থিত। এতে বিশেষভাবে টাকার খেলাই প্রতিভাত হয়। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আইন প্রণেতাগণ আইন প্রণয়নের চেয়ে উন্নয়নেই বেশি আগ্রহী।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কখনো কাঙ্খিত ছিল না। তৃণমূল পর্যায়ে এই নির্বাচন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচন বলা যায় কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিদায়কালে আত্মবিশ্লেষণের তাগিদে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভূক্তভোগীরা যে সকল অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। লিখিতভাবে যে সব অভিযোগ পাঠানো হয়, তারও যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভূক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না।
নিজের ‘সবশেষ ব্রিফিংয়ে’ বরাবরের মতো লিখিত বক্তব্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাবিঘ্নগুলো দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য সংবিধান ও বিধিবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে।
‘নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে’
ওদিকে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির সাথে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের ইলেকশন প্রসেস এবং ইলেকশন কমিশন ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সমস্ত লোক দরকার, যারা এটাকে টেনে তুলতে পারবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে এবং একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে, এ রকম সাহসী লোক দরকার।’
তিনি গত দুটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন যদি আগের মতো হয়, তবে আমরা একটা বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। রাজনীতির যত খেলাই হোক না কেন, নির্বাচন যতক্ষণ গ্রহণযোগ্য না হবে, আমাদের সমস্যা থেকেই যাবে।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংবিধানে বলা আছে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এখানে বলা নেই দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন কমিশনের কথা। কোনো দল যদি নাম দিয়ে থাকে, তিনি সাহসী হতে পারেন, ভালো হতে পারেন; তথাপি তাঁর ওপর দলের ছাপ পড়ে যাবে। যেটা আমরা গত নির্বাচন কমিশনে দেখেছি। যতগুলো নাম দিয়েছে সব কটি নাম প্রকাশ করা হোক।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত সার্চ কমিটির কাছে ৩২৯ জনের নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল থেকে প্রস্তাব এসেছে ১৩৬ জনের। পেশাজীবী সংগঠন দিয়েছে ৪০টি নাম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসেছে ৯৯ জনের। ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজে নিজেকে প্রস্তাব করেছেন ৩৪ জন। এ ছাড়া বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় পাওয়া গেছে ২০ জনের নাম।
আগামীকাল বিকেলে সার্চ কমিটির পরবর্তী বৈঠকে ১০ জনের একটি তালিকা তালিকা চূড়ান্ত করা হবে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এ তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে। রাষ্ট্রপতি সে তালিকা থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।